১৯০১ সালে ভারতের রাজ্য পুতনার অধিবাসী কুনিরাম শেঠী সর্বপ্রথম সরিষাবাড়িতে ‘কুনিরাম শেঠী এন্ড কো:’ নামে একটি পাটক্রয় কেন্দ্র স্থাপন করেন। ১৯০৫ সালের মধ্যে এই মহকুমার একমাত্র সরিষাবাড়ীতেই ভারতীয় ব্যবসায়ী মালিকানায় বিড়লা ব্রাদার্স লি:, মেসার্স লক্ষী নারায়ন মুদ্রা লি:, লুইচ ডেফার্স এন্ড কোং ও বেঙ্গল জুট বেলিংসহ কয়েকটি জুট প্রেস হাউজ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। কলকাতা ও ইউরোপ কেন্দ্রিক ব্যবসায় প্রসার লাভের কারনে সরিষাবাড়ী এলাকাটি বাণিজ্যিক রপ্তানি কেন্দ্র হিসেবে উপমহাদেশের দেশগুলোর কাছে পরিচিতি ছিল। ব্রহ্মপুত্রের ধারে সদর থানার ইটাইল নদীবন্দর হতে এক সময় পাট নিয়ে নৌকা কলকাতা, মাদ্রাজ ও হুগলী যেত। সরিষাবাড়ীতে উৎপাদিত পাট নেওয়ার জন্য হাজার হাজার নৌকা যমুনা নদীতে ভীড় করতো.
কলকারখানাঃ-
১৯৫৮ সালে দেওয়ানগঞ্জ ‘ জিলবাংলা সুগার মিলস’ এবং ১৯৬৭ সালে সরিষাবাড়ীতে ‘ আলহাজ্ব জুট মিল লি: নামে তৎকালীন মহকুমার বৃহৎ দু'টি শিল্প কারখানা স্থাপিত হয়। শিল্পায়নের জন্য অতীত ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় বর্তমান জেলার সরিষাবাড়ী উপজেলার তারাকান্দিতে স্থাপিত হয়েছে এশিয়ার অন্যতম বৃহৎশিল্প কারখানা ‘ যমুনা ফার্টিলাইজার কোম্পানী লি:।
কাঁসা শিল্প :-
ইসলামপুরের কাঁসার বাসন দেশ বিখ্যাত। সরকার বা দেশবাসীগণ হইতে আনুকুল্যের অভাবে এই শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলি লুপ্ত হতে চলছে । দরিয়াবাজের সনমাসুদ কাশারী, রনমামুদ কাশারী, গেন্দল কাশারী, জঙ্গি কাশারী, অলী কাশারী, কলম কাশারী, ইসলামপুরের জগচ্চন্দ কর্মকার, শীতল কর্মকার, মথুর কর্মকার, মাখন কমর্কার, শ্রীমন্ত কর্মকার ও মনমোহন কর্মকার প্রভৃতি কাঁসা শিল্পীগণ এই শিল্পের যথেষ্ট উন্নতি করেছেন ।
নকশী কাঁথাঃ-
জামালপুরের নকশী কাঁথা ও হাতের কাজের বাহারী পোষাক পরিচ্ছদ সারাদেশে বহু পূর্ব থেকেই প্রশংসিত ছিল। বর্তমানে তা আরো উন্নত হয়ে দেশে ও দেশের বাইরেও সমাদৃত হচ্ছে। জামালপুরের সবগুলো উপজেলাতেই কাঁথা শিল্পের কম বেশী উৎপাদন হয়। জামালপুরের পোষাক পরিচ্ছদের গুনগতমান উন্নত হওয়ায় এবং দাম তুলনামূলকভাবে কম হওয়ায় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকার এসে এখান থেকে এগুলো ক্রয় করে নিয়ে যাচ্ছে।
এ হস্ত শিল্পের মাধ্যমে বহু বেকার এবং অশিক্ষিত মহিলার আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে অনেকেই এ সব হস্ত শিল্পের সাথে জড়িত হয়ে কর্মসংস্থানের পথ খুঁজে পেয়েছে। সরকারী সাহায্য সহায়তা এবং পর্যাপ্ত ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করা হলে এ অঞ্চলের মহিলারা হস্ত শিল্পের সামগ্রী বিদেশে রপ্তানী করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে দেশের অর্থনীতিতে বিরাট অবদান রাখতে পারে।
মৃৎ শিল্পঃ-
কুমার সম্প্রদায় এ অঞ্চলে গ্রামীণ লোকায়ত জীবনে পোড়া মাটির শিল্প দ্রব্য এবং তৈজসপত্র তৈরী করে ব্যাপকভাবে পরিচিতি অর্জন করেছে। ১৯০১ সালের লোক গগণা হিসেবে জামালপুরের কুমার পরিবারের লোক সংখ্যা ছিল ১৫০০ জন। এরা হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত ছিল। এদের তৈরী জিনিসপত্র জামালপুরসহ সারা দেশেই সমাদৃত ছিল। সে আমলে ভাত তরকারীসহ রান্না-বান্নার যাবতীয় কাজ মাটির হাড়ীতেই হত। মাটির কলসে পানি রাখত, মাটির গ্লাসে পানি এবং কাদাতে (থাল) ভাত খেত। বর্তমানে আধুনিক এল্যুমিনিয়াম, ষ্টিল এবং মেলামাইনের তৈজসপত্র তৈরীর ফলে মাটির বাসন কোসন প্রায় বিলুপ্ত হতে চলেছে। তবে এখনও কিছু কিছু পরিবারে মাটির বাসন কোসনের ব্যবহার করতে দেখা যায়। মৃৎ শিল্পের সাথে জড়িতদের অনেকেই পৈত্রিক পেশা পরিবর্তন করে অন্য পেশায় কাজ করতে উৎসাহী নয় ।ফলে তাদেরকে মানবেতন জীবন যাপন করতে হচ্ছে। এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে এবং এ পেশার সাথে জড়িতদের কথা বিবেচনা করে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া প্রয়োজন।
তাঁত শিল্পঃ-
জামালপুরের তাঁত শিল্প এক সময় খুবই উন্নত ছিল। বর্তমানে এ শিল্পটি মৃতপ্রায়। জেলার সদর উপজেলার দিকপাইত,মেষ্টা ও তিতপল্লা ইউনিয়নে বর্তমানে কিছু তাঁতী রয়েছে। বকশীগঞ্জ উপজেলায় একটি টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট রয়েছে। এ শিল্পটিকে সরকারিভাবে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করা হলে শিল্পটি আবারো তার হৃত গৌরব ফিরে পেতে পারে।
পাট শিল্পঃ-
সোনালী আশেঁর দেশ বাংলাদেশ । বৃহত্তর ময়নসিংহ জেলার জামালপুরে প্রচুর পাট উৎপন্ন হত।এখানকার সবগুলো থানাতে আবাদ হত। তবে চরাঞ্চলের অপেক্ষাকৃত নিচু জমিতে এর ফলন ভাল হয় । এখানকার পাট খুবই উন্নত জাতের হত। পাটের আবাদ এখানে বেশী হওয়ার ফলে এখানে বেশকিছু কোম্পানী পাট কল গড়ে তুলে। সরিষাবাড়ী আলহাজ্ব জুট মিলস, পপুলার জুট মিলস, ইস্পাহানী জুট বেলার্স, বিজেএমসি,বিজেসিসহ অনেক সংস্থা পাটের ব্যবসা করত। ইংরেজগণ সরাসরি এখানকার পাট সরিষাবাড়ী,দেওয়ানগঞ্জ,নান্দিনা ও বকশীগঞ্জ থেকে নৌ পথে রপ্তানী করত। পাট শিল্পের সাথে জড়িত হয়ে বহু মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হত।
যন্ত্র শিল্প :-
পুর্বে গরীব ধনী সকল গৃহস্তের মেয়েরাই কার্পাস হতে কেড়কী যন্ত্রে তুলা বের করত এবং এই তুলা হতে চরখা ও টাউকা (টাকু) যোগে সুতা কেটে তাতি ও জোলাগণদ্বারা বস্ত্র তৈরী করতো। গুটি পোকার চাষ করে এন্ডি ও মুগার কাপড় তৈরী করত । এই যান্ত্রিক যুগে মিলের সাথে প্রতিযোগিতা করে এই সব কুটির শিল্প কিভাবে টিকে থাকবে ? তথাপি নরুন্দি, নান্দিনা, রঘুনাথপুর প্রভৃতিস্থানের তাতিগণ এখনও উত্তম বস্ত্র বয়ণ করছে। গাড় ও হাজং স্ত্রীলোকেরা এখনও তাদের পরিধেয় নিজেই তৈরী করে। ব্রাক্ষ্মন কুমারীগণ যজ্ঞোপবীতের জন্য অতিই সুক্ষ্ণ কার্পাস সুতা তৈরী করেন।
বিসিক শিল্পনগরীঃ
জামালপুর জেলা শহরের দাপুনিয়ায় ২৬.৩০ একর জমিতে বিসিক শিল্প নগরী ১৯৮০ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয়। এখানে স্থানীয় চাহিদা ও কাচামাল নির্ভর ক্ষুদ্র শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছে। এসব শিল্প প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে শিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস